Author Topic: একজন রোগীর জীবন মরণের কাহিনি  (Read 804 times)

bbasujon

  • Administrator
  • VIP Member
  • *****
  • Posts: 1827
  • I want to show my performance at any where
    • View Profile
    • Higher Education
হাঁসফাঁস করছে ছেলেটি, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না।’
তার কণ্ঠস্বর ও মুখে ভয়ের ছায়া।
হাসপাতালের বেডে অস্থির, এপাশ-ওপাশ করছিল ছেলেটা। তার নাক-মুখ ঢেকে রেখেছিল যে স্বচ্ছ প্লাস্টিক মুখোশ, তা সে সবলে টানছিল।
অ্যালার্ম বাজল। আইসিইউ নার্সরা সজাগ হলো। বাচ্চাটির বিপদ।
নার্সরা আসার আগেই বাচ্চাটির মা অক্সিজেন মাস্ক বদলে দিয়েছেন, মুখে টোকা দিতে দিতে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন বাচ্চাকে।
শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নাহার ছেলেটিকে নিয়ে উদ্বিগ্ন তো বটে। সেই সকালে যখন তিনি তাকে প্রথম দেখেছিলেন, তখন তার কেবল একটু জ্বর, অন্যথা ভালোই ছিল ছেলেটি। কিন্তু এর পর থেকে উপসর্গ বেড়ই চলল। মুখের নিচের অংশ ঢেকে আছে যে মাস্কের মধ্য দিয়ে শতভাগ অক্সিজেন পাচ্ছিল ছেলেটি, তবু রক্তে তার অক্সিজেন ভয়ানক কম। আমরা সাধারণ শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় যে বাতাস নেই, এতে থাকে ২০ শতাংশ অক্সিজেন। আর সে শ্বাসক্রিয়াও করছিল খুব দ্রুত, স্বাভাবিক হারের চেয়ে তিন গুণ হারে।
মাঝেমধ্যে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল, শরীল কাঁপানো শীত শীত ভাব—কম্বলের পর কম্বল চাপিয়েও শীত মানছিল না তার—জ্বর উঠছিল ১০৫০।
হিস্টরি শিট ও চার্ট পর্যালোচনা করে অধ্যাপক নাহার দেখলেন, ছয় দিন আগেও ভালোই ছিল ছেলেটি, একদিন জ্বর ও গলাব্যথা নিয়ে ঘুম থেকে উঠল সকালে।
পারিবারিক চিকিৎসককে দেখানো হলো। তিনি বললেন, স্ট্রেপথ্রোট এবং দিলেন পাঁচ দিনের অ্যাজিথ্রোমাইসিনের কোর্স থ্রোট সোয়াব টেস্ট করালেন না তিনি। ভাবলেন, রোগনির্ণয় তো স্পষ্ট। এন্টিবায়োটিক সত্ত্বেও জ্বর উঠতে লাগল, ১০২০ উঠলো, আর ভেতর থেকে ব্যথা ও ফোলা চলে এল ঘাড়ের ডান দিকে।
বুকের এক্স-রেতে পাওয়া গেল, দুটো ফুসফুসে কয়েকটি ছোট ছোট সাদা ছোপ।
রক্ত পরীক্ষায় পাওয়া গেল শ্বেতকণিকার সংখ্যা বেশ বেড়েছে। বেশির ভাগ শ্বেতকণিকারা ছিল অপরিণত, বলয়রূপী। এতে বোঝা গেল, দেহের বড়মাপের যোদ্ধা কোষগুলোর অনেকগুলো একটি গুরুতর সংক্রমণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
জরুরি বিভাগের চিকিৎসকেরা শুরু করলেন চিকিৎসা দুটো এন্টিবায়োটিক দিয়ে। তাঁরা ভাবলেন, নিউমোনিয়া হয়েছে ছেলেটির। অবশ্য তার এত কাশ ছিল না। এক্স-রেতেও তেমন তাৎপর্যপূর্ণ কিছু ছিল না, যা দিয়ে এক সপ্তার জ্বর ও শ্বাসকষ্টের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আর তেমন অস্বাভাবিক কিছু নেই।
হাসপাতালে ভর্তির পর তার জ্বর যখন বেড়ে গেল, ১২ ঘণ্টা পর রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেল। তৃতীয় আরেকটি এন্টিবায়োটিকও যোগ করা হলো। কী হতে পারে? চিকিৎসকদের উদ্বেগ এজন্য যে লুকিয়ে থাকা কোনো একটি সংক্রমণ ফুসফুসে সংক্রমণ বিস্তার করছে। এজন্যই হয়তো সবিরাম জ্বরে হচ্ছে এবং বুকের এক্স-রেতে ছোপ ছোপ দাগ পাওয়া গেল। অনেকগুলো ডায়াগনোসিস এল চিকিৎসকদের চিন্তার মধ্যে।
এনডোকার্ডাইটিস? হূৎপিণ্ডের কপাটিকায় প্রদাহ? এমন হলে অটল জ্বর হয় এবং সারা শরীরে সংক্রমণের বিস্তার ঘটায়। একটি বিরল জীবাণু সংক্রমণ—লিমিয়ারেস সিনড্রোমও হতে পারে। টনসিলে শুরু হয়। এরপর গলার রক্তনালীতে প্রবেশ করে, রক্ত জমাট বাঁধায়, ফুসফুসেও হয় সংক্রমণ!
রাত যত গভীর হলো, শ্বাসকস্ট তত বাড়ল। পরের দিন খুব সকালে শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন নেই, দেওয়া হলো ভেনটিলেটার। এমনিভাবে তাকে বাঁচিয়ে রাখা।
উদ্বেগে ভরা তিনটি দিন পার হলো। চিকিৎসক দলের কাছে হঠাৎ একটি ক্লু এল। ডা. নাহার দেখলেন, তাঁর রেসিডেন্ট ডাক্তার রোগীর ফাইলে নতুন ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট দেখছেন। কী এগুলো। মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব থেকে রক্তের কালচারের একটি রিপোর্ট…মনে করা হচ্ছে কনটামিনেন্ট! না! রেসিডেন্ট বললেন, ম্যাডাম, তা-ই হবে। ডা. নাহার আরও ভাবলেন, কী হতে পারে এই অদ্ভূত জীবাণুটি?
ফিউসোব্যাকটেরিয়াস নেক্রোকরাম—এই জীবাণুর সন্ধান পাওয়ায় অধ্যাপক নাহার মনে হয় পেলেন রহস্য উন্মোচনের সূত্র। রোগটি তাহলে কী?
লিমিয়ারে সিনড্রোম। ডা. আদ্রে লিমিয়অরের নামে নাম এ রোগের। ১৯৩০ সালে তিনি বর্ণনা দেন, এ রোগে বাচ্চাদের ও তরুণদের মধ্যে গলা খুসখুস, প্রথমে গলাব্যথা, তারপর গলা ফুলে যায়, প্রচণ্ড ব্যথা হয়। সেখান থেকে সংক্রমণ যায় ফুসফুসে, অনেক সময় মগজেও। এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে রোগটি ছিল প্রাণনাশী। ১৯৬০ ও ১০৭০-এর দশকে গলা খুসখুস ও ব্যথার চিকিৎসায় পেনিসিলিনের ব্যাপক ব্যবহারে রোগটি প্রায় নির্মূল হয়ে গিয়েছিল। তবে গত ২০ বছরে লিমিয়ারে রোগ মনে হয় ফিরে এল। এন্টিবায়োটিকের সতর্ক ব্যবহার, নতুন ওষুধ যেমন অ্যাজিথ্রোমাইসিনের মতো জোরালো ওষুধের আবির্ভাবের সুযোগ করে দিল। অ্যাজিথ্রোমাইসিনে স্ট্রেপথ্রোট চিকিৎসা হলো কিন্তু লিমিয়ারে রোগে তেমন কিছু হলো না।
লিমিয়ারে রোগে সবচেয়ে বড় কারণ হলো, ফিউসোব্যাকটেরিয়াস নেক্রোফরাম। ব্যাকটেরিয়া পজিটিভ কালচার এবং সেই সঙ্গে ছেলেটির গলার ভেতর থেকে গলাও গ্রীবা পর্যন্ত সংক্রমণ বিস্তার হওয়ায় অধ্যাপক নাহার রোগটি নির্ণয় করলেন, যদিও আলট্রাসাউন্ড রক্তের জমাট বাঁধার ক্লু পাওয়া যায়নি।
ডা. নাহার দ্রুত পরিবর্তন করলেন অ্যান্টিবায়োটিক। পেনিসিলিন থেকে বেশি কার্যকর হবে এমন একটি অ্যান্টিবায়োটিক তিনি পছন্দ করলেন। এখন তো রোগ নির্ণয় হয়েছে, যদি এ বাচ্চাটির কোনো উপকার হয়।
কখনো এমন হয় রোগীকে জীবন্ত রাখার জন্য কঠোর শ্রম করা হলো, রক্ত বহমান রাখতে, ফুসফুসকে কর্মক্ষম রাখতে, অক্সিজেনে ভরপুর হতে চেষ্টা করা হলো জটিল, দুশ্চিকিৎসা রোগ থেকেও বেঁচে উঠতে পারে রোগী।
আমাদের প্রযুক্তির অগ্রগতি এমন অলৌলিক ঘটনা ঘটাতে পারে।
তবু এমন সময় আসে, যখন রোগীর জন্য, রোগের নিরাময়ের জন্য যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, তা যেন যথেষ্ট হয় না। ছেলেটির ফুসফুস আর সচল ও সক্রিয় হলো না। যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া সে আর শ্বাসক্রিয়া করতেই পারল না।
তিন হপ্তাহ পর আইসিইউতেই মারা গেল ছেলেটি।
তার মা-বাবা শয্যার পাশেই ছিলেন। হঠাৎ তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল। ডা. নাহার খুব কষ্ট পেলেন মনে এ মৃত্যুতে। বাচ্চাটি কেন যেন সবার মন কেড়ে নিয়েছিল এক দিনের মধ্যে। রোগ নির্ণয়ে দেরি হলো। তাই মনে খচখচ করে ওঠে তাঁর। এখন যাদের গলা খুসখুস হবে, তাদের সবার গলার ভেতর সোয়াব নিয়ে কালচার করে দেখা হবে, স্ট্রেপ ও লিমিয়ারে দুটোরই জন্য। এ রকম সিদ্ধান্ত তিনি নিলেন।
এ কাহিনি বলা হলো এজন্য যে রোগজীবাণু মানে না দেশ-কাল-পাত্র। বিরল রোগ অনেক সময় নতুনভাবে জেগে উঠে প্রাণের বিপর্যয় ঘটাতে পারে—কথাটি মনে রাখতে হয় সংশ্লিষ্টদের।

অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল সাম্মানিক অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৭, ২০১০
Acquire the knowledge and share the knowledge so that knowing,learning then sharing - all are the collection