Author Topic: কিডনি সংযোজন ও একটি মানবিক আবেদন  (Read 1046 times)

bbasujon

  • Administrator
  • VIP Member
  • *****
  • Posts: 1827
  • I want to show my performance at any where
    • View Profile
    • Higher Education
সাব্বির ও শাহেদ (ছদ্ম নাম) দুই যমজ ভাই। দুই ভাই-ই শেষ পর্যায় দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগে আক্রান্ত। বিধবা মায়ের চোখের মণি দুই ভাই ডায়ালাইসিস চিকিত্সার মাধ্যমে কোনোমতে বেঁচে আছে। অথচ কিডনি সংযোজনের মাধ্যমে দু্ই ভাই নতুন জীবন ফিরে পেতে পারে। এখন প্রশ্ন, এই কিডনি দেবে কে?
বর্তমানে পৃথিবীতে কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ রোগে আক্রান্তের হার খুব বেশি। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দুই কোটি লোক কোনো না কোনো কিডনি রোগে ভুগছে। প্রতি মিলিয়নে ১২০ থেকে ১৫০ জন মানুষ শেষ পর্যায়ে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগে আক্রান্ত হয় এবং প্রতিবছর এ রোগে মৃত্যুবরণ করে প্রায় ৩৫ হাজার লোক। গত ১০ বছরে কিডনি রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় এক কোটি। সমস্যা হলো, তাদের মধ্যে অধিকাংশ লোকই জানে না সে কিডনি রোগে ভুগছে এবং যখন কিডনি রোগ শারীরিক সমস্যা তৈরি করে, তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডায়ালাইসিস বা কিডনি সংযোজন ব্যতীত অন্য কোনো উপায় থাকে না।
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনির প্রদাহ—এ তিনটিই ক্রনিক কিডনি বা দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগের মূল কারণ। সাম্প্রতিককালে এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে বাংলাদেশে প্রায় ১৭ শতাংশ লোক ক্রনিক কিডনি রোগে আক্রান্ত, অস্ট্রেলিয়ায় এ হার ১৬ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১১ শতাংশ। ক্রনিক কিডনি ডিজিজ বা দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীর সমান বা বেশি। তবে সবচেয়ে বেশি আশঙ্কার ব্যাপার এই যে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ দুটিই আবার দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগের অন্যতম কারণ। ফলে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে বিবেচিত।
আমরা যদি নিয়মিত রক্তচাপ মাপি এবং ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগের জন্য রক্ত পরীক্ষা করি, তবে শুরুতেই কিডনি রোগ শনাক্ত করা সম্ভব। প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি রোগ ধরা পড়লে এবং উপযুক্ত চিকিত্সা দিলে কিডনি অকেজো রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কমানো সম্ভব। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে, এমনকি শহরেও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৯০ শতাংশ লোকেরই রক্তচাপ সব সময় নিয়ন্ত্রণে থাকে না। একই অবস্থা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রেও, যা খুবই ভয়ংকর, অথচ শুধু ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে আমরা কিডনি রোগ বহুলাংশে প্রতিরোধ করতে পারি।
এ তো গেল প্রতিরোধের কথা। আর শেষ পর্যায় দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগের মূল চিকিৎসা হলো ডায়ালাইসিস বা কিডনি সংযোজন। ডায়ালাইসিস চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং যন্ত্রনির্ভর, যাতে বছরে খরচ হয় প্রায় তিন থেকে চার লাখ টাকা। অপরদিকে সরকারি হাসপাতালে কিডনি সংযোজনে খরচ পড়ে দেড় লাখ থেকে দুই লাখ টাকা। তারপর প্রতিবছর ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা ওষুধ বাবদ খরচ হয়। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, কিডনি সংযোজনই শেষ পর্যায় দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগের আদর্শ চিকিৎসা। ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে কখনোই কিডনির সব কাজ সম্ভব নয়, শুধু একটি কিডনিই করতে পারে আরেকটি কিডনির কাজ।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে বাংলাদেশে কিডনি সংযোজনের হার খুবই কম। যদিও নয়টি হাসপাতালে কিডনি সংযোজন করা যায়। বর্তমানে শুধু জীবিত ব্যক্তি তার নিকটাত্মীয়কে কিডনি দান করছে। কিন্তু কোনো ব্যক্তি তার মৃত্যুর পর কিডনি দান করতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি বলে এখনো মৃত ব্যক্তি থেকে কিডনি সংযোজনের প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। মানুষের মধ্যে অঙ্গ দান করার ব্যাপারে সচেতনতার অভাব আছে। একটি কিডনির অভাবে যেমন কিডনি অকেজো রোগী ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি কতিপয় দালাল কিডনি বিক্রির ব্যবসায়ে অসুস্থ রোগীকে প্রলুব্ধ করছে। এই অসাধু ব্যবসা বন্ধ ও অঙ্গ সংযোজন প্রক্রিয়া গতিশীল করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সংসদ ১৯৯৯ সালে মানব দেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ১৯৯৯ পাস করে। এ আইনে সুনির্দিষ্টভাবে অঙ্গ দানকারীর সংজ্ঞা, গ্রহীতার সংজ্ঞা, ব্রেইন ডেথ ঘোষণা, নিকটাত্মীয়ের সংজ্ঞা, উত্তরাধিকারীর সংজ্ঞা এবং এ আইন অমান্যকারীর জন্য শাস্তির বিধান বর্ণিত আছে। ১৮ বছর বা তার অধিক বয়সের যেকোনো সুস্থ বা সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় তার নিকটাত্মীয়ের (ছেলেমেয়ে, মা-বাবা, ভাইবোন ও রক্ত-সম্পর্কিত আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা ও স্বামী-স্ত্রী) দেহে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের জন্য দান করতে পারবেন। এই নিকটাত্মীয়ের সম্পর্ক ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় অঙ্গ দান করতে পারবেন না। কিন্তু মৃত্যুর পর যে কেউ যেকোনো ব্যক্তিকে অঙ্গ দান করতে পারবেন। মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় বা তার বিনিময়ে কোনো সুবিধা লাভ বা এই উদ্দেশ্যে কোনো প্রকার বিজ্ঞাপন প্রদান বা অন্য কোনোরূপ প্রচারণা এই আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ আছে। এই আইনের লঙ্ঘন করলে বা লঙ্ঘনে সহায়তা করলে তিন থেকে সাত বছরের জেল বা অর্থদণ্ড বা উভয় প্রকার দণ্ডের বিধান আছে।
লেখার শুরুতে যে দুই সহোদরের সমস্যার কথা বলেছি, তার সমাধান মূলত লুকিয়ে আছে মানুষের সচেতনতার মধ্যে। তাদের নিকটাত্মীয় কিডনি দান করলেই তাদের জীবনে প্রাণ ফিরে পেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কেউ কিডনি দেওয়ার জন্য উপযুক্ত নয় আর যারা উপযুক্ত তারা কিডনি দিতে ইচ্ছুক নয়। এখানে উল্লেখ্য, প্রতিটি ধর্মেই অঙ্গ দান করার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। অধিকন্তু কিডনি দান করার পরে কিডনি দানকারী সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। এখন প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
আমরা যদি একটু সচেতন হই, তবে একজন মানুষ তার মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১০ জন মানুষকে নতুন জীবন দিতে পারে। এই সচেতনতার ব্যাপারে মিডিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সরকার দেশে একটি অঙ্গ সংযোজন নেটওয়ার্ক কার্যক্রম শুরু করতে পারে, যার মাধ্যমে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান ও সংযোজন কার্যক্রম পরিচালিত হবে এবং সেই সঙ্গে সময়ের প্রয়োজনে মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনের পরিবর্তন বা পরিবর্ধন সাধন সম্ভব হবে।

মানস সাহা
কিডনি রোগ-বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি, শেরেবাংলানগর, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১০, ২০১০
Acquire the knowledge and share the knowledge so that knowing,learning then sharing - all are the collection