সিজারিয়ান ডেলিভারি ধাত্রীবিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। সম্রাট জুলিয়াস সিজার নাকি এভাবে জন্মেছিলেন। ধারণাটি সঠিক নয়। সম্ভবত লাতিন শব্দ থেকে এ নামের উৎপত্তি। রোমান সাম্রাজ্যে কোনো গর্ভবতী মারা গেলে তাঁর পেট কেটে মৃত বাচ্চাটি বের করে আনা হতো এবং আলাদা দাফন করা হতো। দলিল ঘেঁটে দেখা যায়, প্রায় ৪০০ বছর আগে সর্বপ্রথম জীবিত একজন মায়ের শরীরে এ ধরনের অপারেশন করা হয়।
নানান বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সন্তান জন্মদানের এ কৃত্রিম পদ্ধতিটি আজ অনেক আধুনিক ও নিরাপদ। এ প্রক্রিয়ায় বিশ্বের লাখ লাখ মা ও শিশুর জীবন রক্ষা হয়েছে।
সিজারিয়ান ডেলিভারি করার নির্দেশনাগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক. যখন নরমাল ডেলিভারি সম্ভবই নয় (গর্ভফুল দিয়ে জরায়ুমুখ ঢেকে থাকা, মায়ের কোমর ও বাচ্চার মাথার আকারের বড় ধরনের অসামঞ্জস্য, তলপেটের বড় টিউমার ইত্যাদি)। দুই. নরমাল ডেলিভারি সম্ভব, কিন্তু মা-বাচ্চার জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। দ্বিতীয়টির নির্দেশনা তালিকা বেশ দীর্ঘ। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যথেষ্ট চেষ্টার পরও যদি স্বাভাবিক প্রসব না হয়।
প্রসবব্যথা চলাকালে যদি মা ও বাচ্চার শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হয়।
বাচ্চা যদি উল্টোভাবে অথবা আড়াআড়িভাবে গর্ভে অবস্থান করে।
একলাম্পশিয়া বা খিঁচুনি।
মায়ের হূদেরাগ, ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য রোগ।
যদি পূর্ববর্তী দুই বা ততোধিক সিজারিয়ান ডেলিভারির ইতিহাস থাকে, ইত্যাদি।
অবস্থাভেদে এ অপারেশন দুই ধরনের হতে পারে। প্রথমটি ইলেকটিভ। এ ক্ষেত্রে মা ও বাচ্চার অবস্থা বুঝে আগে থেকেই অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইলেকটিভ সিজারিয়ান ডেলিভারির উপযুক্ত সময় হচ্ছে অফিস টাইম। তখন জ্যেষ্ঠ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, শিশু বিশেষজ্ঞ, অ্যানেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ সবাই উপস্থিত থাকেন বলে মা ও নবজাতকের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। অফিস টাইমে বড় হাসপাতালগুলোতে সিজারিয়ান ডেলিভারির রেট বেশি হওয়ার এটাই কারণ। দ্বিতীয় ধরনটি হলো ইমার্জেন্সি। নাম থেকেই বোঝা যায় এর তাৎপর্য। হাসপাতালে আসার এক ঘণ্টার মধ্যেই চিকিৎসক সিজার করে ফেললেন। এ ঘটনায় দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়: ‘হাসপাতালে এলেই খালি সিজার আর সিজার।’ এর বিপরীত চিত্রও আছে। কৃতজ্ঞ স্বামী বলছেন, ‘আমার স্ত্রীর যে অবস্থা ছিল! ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে অপারেশন না করলে মা ও বাচ্চা কাউকেই পেতাম না।’ এমনি করে আজীবন কৃতজ্ঞতায় জড়িয়ে পড়েন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১৫ শতাংশ জন্মে সিজারিয়ান ডেলিভারির প্রয়োজন হয়। কিন্তু সারা বিশ্বেই এ হার ক্রমাগত বাড়ছে। এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেকের বক্তব্য রয়েছে। আবার বৈজ্ঞানিক কারণও রয়েছে। সচেতনতা বাড়ায় বেশি সংখ্যক মা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন। উন্নত প্রযুক্তির কারণে মা এবং গর্ভের বাচ্চার সমস্যাগুলো আরও বেশি করে ধরা পড়ছে। যন্ত্রনির্ভর ও ঝুঁকিপূর্ণ ডেলিভারি চিকিৎসকেরা পরিহার করছেন। সর্বোপরি কমসংখ্যক গর্ভধারণের বিষয়টি সবাইকে এমনভাবে সেনসিটাইজ করে যে মা, আত্মীয়স্বজন, চিকিৎসক কেউই ডেলিভারিতে ন্যূনতম ঝুঁকি নিতে রাজি নন। অন্যদিকে অপারেশন টেকনিক, অ্যানেসথেসিয়া, ব্যবহূত ওষুধের মানের এতটাই উন্নতি হয়েছে যে দক্ষ হাতে সিজারিয়ান ডেলিভারি বেশ নিরাপদ। অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল মায়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসচেতনতা তুলনামূলক কম। জীবন বিপন্ন না হলে সহজে তাঁরা স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে আসেন না। এমনকি সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিনা মূল্যের সেবা নিতেও অনেকে অনিচ্ছুক।
অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) বর্তমান সভাপতি অধ্যাপিকা কোহিনূর বেগম বলেন, স্বাভাবিক প্রসব সব নিবেদিতপ্রাণ ধাত্রীবিদেরই প্রথম পছন্দ; সিজারিয়ান ডেলিভারি অবশ্যই দ্বিতীয় ও বিকল্প পদ্ধতি।
এনামুল হক
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৮, ২০১১