আজ জাতীয়শিশু দিবস। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে দিনটিকে শিশু-কিশোরদের জন্যবিশেষদিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আজকের শিশুরাই আগামীদিনের সক্ষম নাগরিক। তাই শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্য-পুষ্টির দিকে নজর দিয়েতাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে।
মায়ের দুধই শ্রেষ্ঠ খাবার
নবজাতকের শ্রেষ্ঠ এবং তাত্ক্ষণিক খাবার ‘মায়ের দুধ’—এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও এখনো নবজাতকের প্রথম খাবার হিসেবে মধু, পানি, গ্লুকোজ পানি ইত্যাদি দেওয়ার প্রচলন আছে। এ চর্চা সংক্রামক রোগের ঝুঁকিকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দিতে পারে। শিশুর জন্মের পরপরই তার মুখে মায়ের দুধ তুলে দিতে হবে। মায়ের দুধ শিশুর জীবনে শুভসূচনা। প্রথম টিকা।
কলোসট্রাম: শালদুধ নামে পরিচিত। সন্তান প্রসবের প্রথম তিন দিন এর নিঃসরণ ঘটে। হলুদ বর্ণের। ঘন, ভারী। নবজাতক শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টিবডি, কোষ, বাড়তি মানের এ, ডি, ই ও কে ভিটামিনসমৃদ্ধ এই শালদুধ পরিমাণে অল্প হলেও এ বয়সের শিশুর চাহিদা মেটাতে সক্ষম।
মায়ের দুধের মাধ্যমে শিশু যে পুষ্টি পেয়ে থাকে তা শিশুর ছয় মাস বয়স পর্যন্ত তার শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশের জন্য যথেষ্ট। ছয় মাস বয়সের পর শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য পুষ্টির যে চাহিদা তা শুধু মায়ের দুধের মাধ্যমে পূরণ হয় না। এ ছাড়া মাতৃগর্ভে থাকাকালীন মায়ের কাছ থেকে পাওয়া যে বিভিন্ন পুষ্টিকর পদার্থ, প্রয়োজনীয় লবণ, ধাতু ও ভিটামিন শিশুর শরীরে সঞ্চিত থাকে, শিশুর জন্মের পর পরবর্তী কিছু সময় পর্যন্ত শিশুর পুষ্টি চাহিদা মেটাতে তা যথেষ্ট। কিন্তু পুষ্টিকর পদার্থগুলোর এই সঞ্চয় শিশুর মোটামুটি পাঁচ মাস বয়সের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যায়। ছয় মাস বয়সের পর শুধু মায়ের দুধ তার পুষ্টিচাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়। তাই শিশুর পাঁচ-ছয় মাস বয়স হলে তাকে মায়ের দুধের পাশাপাশি শিশুর উপযোগী অন্যান্য বাড়তি খাবারও দিতে হবে।
জন্মের সময় শিশুর যে ওজন থাকে, পাঁচ মাস বয়সে তা দ্বিগুণ, এক বছরে তিন গুণ ও দুই বছরের মাথায় তা চার গুণ হয়। শিশুকে বাড়তি হিসেবে দেওয়া খাবারগুলোকে ‘ওয়েনিং ফুড’ বলা হয়। মূলত ওয়েনিং বলতে মায়ের দুধের পাশাপাশি শিশুর পুষ্টিচাহিদা ও গ্রহণযোগ্যতা অনুযায়ী অন্যান্য খাবারে অভ্যস্ত করে তোলাকে বোঝায়। এই অভ্যস্ততা শুরু হয় পাঁচ-ছয় মাস বয়সের শিশুর উপযোগী খাবার দিয়ে এবং শেষ হয় এক বছর বয়সে পূর্ণবয়স্ক লোকের খাবারের সমমানসম্পন্ন খাবার দিয়ে।
পুষ্টি নিয়ে তুষ্টি নেই
শুধু অপুষ্টির কারণে যদি বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়—তবে দেশের পুষ্টি নিয়ে তুষ্টি আসার কোনো কারণ নেই। এমনিতেই আমাদের দেশে শিশুমৃত্যুর হার বেশি, মাতৃমৃত্যুর হারও বেশি। এর পেছনে রয়েছে অপুষ্টির দুষ্টচক্র। একজন অপুষ্ট কিশোরী হয়ে ওঠে অপুষ্ট মা, জন্ম দেয় অপুষ্ট শিশুর, কম ওজনের শিশু। শতকরা ৩৫ থেকে ৫০ ভাগ শিশু জন্মায় স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজন নিয়ে মায়ের পুষ্টির অভাবে, পুষ্টি পায় না বলে। অপুষ্ট শিশু বেড়ে ওঠে কম মেধাসম্পন্ন কিশোর-কিশোরী হিসেবে। পরিণত বয়সে এই অপুষ্ট শিশু-কিশোরেরাই হয়ে ওঠে অদক্ষ জনগোষ্ঠী—কম উত্পাদনশীল জনগোষ্ঠী। উত্পাদন কম, আয় কম—ফলে কম সেবা, কম পরিচর্যা, কম স্বাস্থ্য। পরিণতি আবারও অপুষ্টি। এই হচ্ছে অপুষ্টির দুষ্টচক্র।
ভাঙতে হবে অপুষ্টির দুষ্টচক্র
অপুষ্টির এই দুষ্টচক্রকে ভাঙতে হবে। তাই শুরু করতে হবে গোড়া থেকেই। আজ যে কিশোরী তাকে কেন্দ্রবিন্দুতে নিতে হবে। অপুষ্টি আক্রান্ত দুর্বল ও অল্প বয়সী মেয়েদের অসময়ে গর্ভধারণ রোধ করতে হবে।
অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া অপুষ্ট কিশোরী-মা গর্ভধারণ করলে—সে নিজে যথাযথ পুষ্টি পায় না, বঞ্চিত হয় গর্ভস্থ শিশুটিও। তাই আজ যে কিশোরী তার পুষ্টি দিয়েই শুরু করতে হবে, সুন্দর আগামীর জন্য।
কৈশোরে পুষ্টি
আমাদের দেশের বড় জনগোষ্ঠী কিশোর-কিশোরী। দুঃখজনক যে কিশোর-কিশোরীরা অধিকাংশই কোনো না কোনো মাত্রায় অপুষ্টিতে ভুগছে। কিশোরীদের অপুষ্টি বেশি প্রকট। কিশোরীর নতুন অভিজ্ঞতা—মাসিক ঋতুস্রাব। শঙ্কা থেকে লজ্জা, লজ্জা থেকে ভয়, ভয় থেকে অযত্ন, অযত্ন থেকে অপুষ্টি। তাই কিশোরীদের জন্য চাই বাড়তি খাবার, বাড়তি পুষ্টি, বাড়তি যত্ন।
ক্ষমা চাই, কিশোরী মায়ের কাছে
আঠারোর আগে বিয়ে আইনসিদ্ধ নয়, তবু হচ্ছে। বেশি মাত্রায়ই হচ্ছে। সামাজিক বাস্তবতা হলো, গবেষণালব্ধ ফলাফল, একজন কিশোরী যৌনপ্রাপ্ত হওয়ার আগেই বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করে। বেশির ভাগ মা-ই হয়ে ওঠেন কিশোরী-মা। কিশোরী মায়ের মানসিক ও শারীরিক পুষ্টিহীনতা আবার জন্ম দেয় অপুষ্ট শিশুর। মরণকে বরণ করে বেশির ভাগ কিশোরী মাই। মাতৃমৃত্যু এবং শিশুমৃত্যু আবারও বাড়ে। তাই কিশোরী মা নয়, চাই কিশোরী বোন, কিশোরী বন্ধু।
শৈশব-কৈশোরে পুষ্টি, জাতির উন্নয়ন-সূচক
শিশু-কিশোরেরাই বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। আজকের এরাই আগামীকালের উত্পাদনক্ষম মানুষ। তাই এদের অপুষ্টির জন্য বিনিয়োগ মানেই জাতীয় উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ।
পুষ্টি-বিনিয়োগ তাই প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্ত। পুষ্টি মানে নিছক খাবার-দাবার নয়, পুষ্টি মানে ভিটামিন নয়, পুষ্টি মানে উন্নয়ন—মানবসম্পদ উন্নয়ন। পুষ্টি আধুনিক মানুষের সম্পন্ন হয়ে ওঠার অধিকার।
বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য পরিচর্যা
বাসার পরে স্কুলই হচ্ছে শিশুদের স্বাস্থ্য গড়া ও শিক্ষার প্রকৃত স্থান। স্কুলগামী শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও আদর্শিক বিকাশের মূল জায়গা হচ্ছে স্কুল। বয়ঃসন্ধিকালের ঝুঁকিপূর্ণ সময়টাই তারা স্কুলজীবনে অতিবাহিত করে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের স্কুলগামী শিশুদের একটি বিরাট অংশ অপুষ্টি ও গঠনস্বল্পতায় ভোগে। তাই তাদের দৈহিক ও বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধিকল্পে বিশেষ নজর দিতে হবে।
শ্রেণীকক্ষে বসার ডেস্ক: প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর আলাদা সিট ও ডেস্ক থাকা ভালো। তবে নির্দিষ্ট কলেবরের বেশি সিট ও ডেস্কেরও আয়োজন করা যেতে পারে। ডেস্কগুলো বেশি উঁচু বা বেশি নিচু হবে না এবং এক ডেস্ক থেকে আরেক ডেস্ক বেশি দূরে বা খুব কাছে থাকবে না। ডেস্কগুলোর উপরিভাগে ছাত্রদের কনুই ও নিম্নবাহু আরামদায়কভাবে স্থাপনের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে পিঠ বাঁকা না করে সুন্দরভাবে বসতে পারে।
স্যানিটেশন: প্রস্রাব-পায়খানার ব্যবস্থা আলাদা আলাদা থাকতে হবে, যা থাকবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক। প্রথম ১০০ ছাত্রের প্রতি ২০ জনের জন্য একটি প্যান ও পরবর্তী ১০০ জন বা ততোধিকের জন্য প্রতি ৩০ জনে একটি প্যান স্থাপন করতে হবে। পরিমিত পানি সরবরাহ ও হাত-মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। মেয়েদের স্কুলে পরিচ্ছন্ন ল্যাট্রিন রাখতে হবে, থাকবে বিশেষব্যবস্থা যাতে বিশেষদিনগুলোতে বয়ঃসন্ধিকালের মেয়েদের অসুবিধা না হয়।
পানীয় জল সরবরাহ: বিদ্যালয়ের আঙিনায় নিরাপদ ও সহজলভ্য পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিশোরীমেয়েরা ল্যাট্রিনে যাওয়ার ভয়ে স্কুল চলাকালীন পর্যাপ্ত পানি পান করে না, পেশাব আটকে রাখে। মেয়েদের মূত্রনালির সংক্রমণ বেশি হওয়ার অন্যতম কারণএটি।
স্বাস্থ্য শিক্ষা: বিভিন্ন ছোঁয়াচে ও সংক্রামক রোগ সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের সচেতন করতে হবে।শিক্ষকদের ন্যূনতম জ্ঞান থাকতে হবে, যাতে কোনো বিশেষ রোগে আক্রান্ত হলেশিশুকে ছুটি দিয়ে বাড়িতে বিশ্রাম ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে অন্য শিশুদের রোগমুক্ত রাখা সহজ হয়।
ইকবাল কবীর
১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, জাতীয় শিশু দিবস সহকারী অধ্যাপক, রোগতত্ত্ব বিভাগ
জাতীয় রোগ প্রতিরোধ ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, নিপসম
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৭, ২০১০