একজন মানুষের কিডনি অন্য একজন অকেজো কিডনির রোগীর দেহে সংযোজন করাকে কিডনি সংযোজন বলা হয়। কিডনি সংযোজন সাধারণত দুই ভাবে করা যায়: মৃত ব্যক্তির কিডনি নিয়ে সংযোজন এবং নিকটাত্মীয়ের যেকোনো একটি কিডনি নিয়ে সংযোজন। আমাদের দেশে বর্তমানে জীবিত নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কিডনি সংযোজন বা লাইফ রিলেটেড কিডনি প্রতিস্থাপন নিয়মিত হচ্ছে এবং এর সাফল্যও উন্নত বিশ্বের যেকোনো দেশের সমান।
কিডনি সংযোজনের জন্য প্রস্তুতি
কোনো রোগীর দুটো কিডনি সম্পূর্ণরূপে অকেজো হয়ে গেলে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রথম প্রয়োজন হয় ডায়ালাইসিসের। রোগীর উপসর্গের ইতিহাস, রক্তের ক্রিয়েটিনিন, ইউরিয়া, ইলেকট্রোলাইট, সনোগ্রাম করে কিডনির অবস্থান ও আকার দেখা, এফজিআর বা সিআর ইত্যাদি পরীক্ষা করে কিডনি অকেজো রোগ নির্ণয় করা হয়। কিডনি সম্পূর্ণ অকেজো জানার পরই ডায়ালাইসিস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সাধারণত দুই ধরনের ডায়ালাইসিসের প্রচলন আছে—পেরিটোনিয়েল ডায়ালাইসিস ও হেমোডায়ালাইসিস।
তবে হেমোডায়ালাইসিস শুরু করার আগে সাধারণত বাঁ হাতের কবজির ওপর একটি এভি ফিস্টুলা করে নেওয়া হয়, যা সমন্বয় হতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। হেমোডায়ালাইসিসে যন্ত্রের পাশাপাশি রোগীকে ও তাঁর নিকট-পরিজনকে রোগ সম্পর্কে ধারণা, চিকিৎসার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সুযোগ-সুবিধা ও আর্থিক দিক সম্পর্কেও সম্যক ধারণা দেওয়া হয়। এর পরই একজন রোগীর সব দিক বিবেচনা করে কিডনি সংযোজন কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়।
মরণোত্তর কিডনি সংযোজন
মৃতপ্রায় ব্যক্তির কিডনি নিয়ে অন্য রোগীকে সংযোজন করা খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার। বর্তমান উন্নত বিশ্বে, যেমন: ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে এর সুব্যবস্থা রয়েছে এবং ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ কিডনি সংযোজন মৃত ব্যক্তির কিডনি নিয়ে করা হয়ে থাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ‘অল ইন্ডিয়া মেডিকেল ইনস্টিটিউট’ এবং পাকিস্তানের এসআইইউটি (সিন্ধু ইনস্টিটিউট অব ইউরোলজি ও ট্রান্সপ্লান্টেশন)-এ সম্প্রতি ক্যাডাভারিক বা মৃত ব্যক্তির কিডনি নিয়ে সংযোজন শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও কিডনি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আশা করা যায় শিগগিরই মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হবে।
জীবিত নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কিডনি সংযোজন
দাতা হিসেবে একজন সম্পূর্ণ সুস্থ ব্যক্তি স্বেচ্ছায় তাঁর কোনো নিকটাত্মীয়, যাঁর দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে, তাঁকে একটি কিডনি দান করতে পারেন। এই কিডনি সংযোজনকে জীবিত নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কিডনি সংযোজন বা লাইফ রিলেটেড কিডনি প্রতিস্থাপন বলা হয়। আত্মীয় ছাড়া কিডনি দান করা আইন ও নীতিগতভাবে ঠিক নয় এবং এটি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। জীবিত নিকটাত্মীয় বলতে মা-বাবা, ছেলেমেয়ে ও ভাইবোন বোঝায়। কিডনি দেওয়ার আগেই তাঁদের রক্তের গ্রুপ ও টিস্যু টাইপ পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া হয়। যখন দেখা যায়, কোনো আত্মীয় দাতার সঙ্গে রোগীর মিল আছে, তখন আত্মীয় কিডনিদাতার সব রকম পরীক্ষা করা হয়। কিডনিদাতার বয়স অবশ্যই ১৮ বছর, অর্থাৎ এইজ অব কনসেন্টের ওপর বা ৬০ বছরের নিচে হতে হবে। তাঁর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, লিভার ও কিডনি রোগ থাকা চলবে না এবং দুটো কিডনিই সম্পূর্ণ ভালো থাকতে হবে। কিডনিদাতাকে স্বেচ্ছায় কিডনি দান করতে হবে, জোর-জবরদস্তি করা চলবে না।
কিডনি দানে স্বাস্থ্যের তেমন সমস্যা হয় না
কিডনিদাতার পরীক্ষা করে সবকিছু নিরাপদ জেনেই তাঁর একটি কিডনি নেওয়া হয় এবং একটি কিডনি নিয়েই স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবন যাপন করা যায়। ফলে একজন জীবিত সুস্থ কিডনিদাতা তাঁর একটি কিডনি দান করেও নিজে সুস্থ থাকেন এবং কিডনি-অকেজো একজন রোগী তাঁর একটি কিডনি সাফল্যজনকভাবে সংযোজন করে নিয়ে পুনরায় সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন। দেখা যায়, কিডনি দান করার ফলে স্বাস্থ্যের ওপর কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় না বা আয়ুও কমে না। উপরন্তু কিডনি দান করার ফলে তাঁর মানবিক গুণাবলির বহিঃপ্রকাশ ঘটে, সম্পর্ক গভীর হয় ও আত্মীয়স্বজনের কাছে মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশে কিডনি সংযোজনের প্রেক্ষাপট
বর্তমানে আমাদের দেশে শুধু লাইভ রিলেটেড কিডনি প্রতিস্থাপন বা জীবিত নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কিডনি সংযোজিত হচ্ছে। ১৯৮৮ সাল থেকে বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) কিডনি সংযোজন শুরু হয়েছে। এখানে বছরে ২০ থেকে ২৫ জন রোগের কিডনি সংযোজন হয়। ২০০৪ সাল থেকে ইব্রাহিম মেমোরিয়াল ডায়াবেটিক হাসপাতাল বা বারডেমে কিডনি সংযোজন শুরু হয়। এখানে বছরে গড়ে ১০ থেকে ১২টা কিডনি সংযোজন হয়। ২০০৬ সাল থেকে কিডনি ফাউন্ডেশনে কিডনি সংযোজন শুরু হয়েছে। এখানে বছরে গড়ে ৪০ থেকে ৪৫টা কিডনি সংযোজিত হয়। দুই বছর ধরে কিডনি ইনস্টিটিউট অব ইউরোলজি বা নিকডুতে এবং ইউনাইটেড হাসপাতালে কিডনি সংযোজন শুরু হয়েছে। এসব হাসপাতালে শুধু লাইফ রিলেটেড কিডনি সংযোজিত হয়।
কিডনি সংযোজনের পরিসংখ্যান
এ পর্যন্ত (জানুয়ারি ২০১০) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৬৫টি, কিডনি ফাউন্ডেশনে ১৪৭টি, বারডেম হাসপাতালে ৫০টি, ইউনাইটেড হাসপাতালে ২৩টি এবং নিকডুতে ১৬টি কিডনি সংযোজন হয়েছে। এর সাফল্যও সন্তোষজনক, যা উন্নত বিশ্বের সাফল্যের সমমানের দাবি রাখে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কিডনিদাতারা সবাই ভালো আছেন ও সুস্থ জীবন যাপন করছেন। শিগগিরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিডনি ও ইউরোলজি বিভাগের সম্প্রসারণ শুরু হবে বলে জানা গেছে। ফলে কিডনি সংযোজনসহ হেমোডায়ালাইসিস ও অন্যান্য চিকিত্সার আরও ব্যাপক বিস্তার হবে বলে আশা করা যায়। এ ছাড়া কিডনি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মিরপুরে বৃহদাকারে কিডনি ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ছয়তলাবিশিষ্ট স্থায়ী ভবন নির্মাণের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলেছে। আগামী জুন নাগাদ সেখানে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হবে বলে আশা করা যায়। এতে কিডনি রোগীদের চিকিত্সার প্রসার ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে।
দরকার যথাযথ উদ্যোগ
বাংলাদেশে স্বল্পসংখ্যক কিডনি সংযোজনের প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা যাচ্ছে নিকটাত্মীয় কিডনিদাতার স্বল্পতা। কাজেই কিডনিদাতার স্বল্পতা কাটিয়ে উঠতে হলে ক্যাডাভারিক কিডনি প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন কিডনি রোগ সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষা ও মোটিভেশন। সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যম ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসা উচিত। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক কিডনিদাতার কার্ডের প্রবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে দেশে কিডনি সংযোজনের হার আরও বৃদ্ধি পাবে। ইতিমধ্যে কিডনি-অকেজো রোগীদের দেশের বাইরে কিডনি সংযোজনের জন্য যাওয়ার প্রবণতা অনেকাংশে কমে এসেছে। এখন দরকার যথাযথ উদ্যোগে ফলপ্রসূ কার্যক্রম গ্রহণ করা।
মো. শহীদুল ইসলাম সেলিম
কিডনি সংযোজনে ব্যস্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা অধ্যাপক, নেফ্রোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (বিএসএমএমইউ), শাহবাগ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১০, ২০১০