মেনোপজের গুরুত্ব সম্পর্কে দুটি কথা ভূমিকায় না বললেই নয়। তা হচ্ছে, সরকার অনুমোদিত উন্নত স্বাস্থ্য প্রকল্প, বিনা বেতনে মেয়েদের শিক্ষা ইত্যাদির বদৌলতে ভবিষ্যতে এ দেশে নারীদের গড় আয়ু ৬২ বছর থেকে আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের জনসংখ্যার শতকরা ৪৯ জন নারী। বয়স্ক নারীদের স্বাস্থ্য নিয়ে সরকারের তরফ থেকে এখনো কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি। অন্যান্য সমস্যার প্রবল চাপে অতিগুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি এখনো অবহেলিত থেকে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে এ দেশের আর্থ-সামাজিক ও স্বাস্থ্যসেবা অঙ্গনে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলবে। বিশ্ব মেনোপজ দিবস উপলক্ষে সবার কাছে আজ যে প্রয়োজনীয় তথ্য পৌঁছে দিতে চাই, সেগুলো গত মার্চে জুরিখে অনুষ্ঠিত ‘প্রথম গ্লোবাল সামিট’-এ আলোচিত পৃথিবীর ৪৭টি দেশের চিকিত্সাবিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের গবেষণা ও চিন্তাভাবনা থেকে সংগৃহীত।
হরমোন কী
কেউ যদি আপনাকে বলে, আপনি ১০ বছর আগে যেমন ছিলেন, তেমনই আছেন। নিশ্চয়ই আপনি মনে মনে খুশি হবেন। কীভাবে তা সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব, যদি আপনার শরীর ও মন থাকে সুস্থ।
আগে ধারণা করা হতো, স্নায়ুতন্ত্রই শরীর ও মনের পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু গবেষণা আজ প্রমাণ করেছে, আসলে শরীরের সব কোষ একাধিক হরমোনের ওপর নির্ভরশীল, স্নায়ুতন্ত্রও এর অন্তর্ভুক্ত।
যদি কোনো কারণে সেটির অভাব হয়, তাহলে বাইরে থেকে তা সরবরাহ করে রোগীর জীবন স্বাভাবিক করা যায়। যেমন ডায়াবেটিসে ইনসুলিন দিয়ে, থাইরয়েডের অভাবে থাইরয়েড হরমোন দিয়ে, ঠিক তেমনি বয়স্ক নারীদের মাসিক বন্ধ হওয়ার সময় হরমোনের অভাবে যেসব অসুস্থতা ও শারীরিক অসুবিধা হয়, সেগুলোও প্রয়োজনে বাইরে থেকে হরমোন সরবরাহ করে সারিয়ে তোলা যায়।
হরমোন-চিকিত্সা ও কোয়ালিটি অব লাইফ
‘কোয়ালিটি অব লাইফ’ ব্যাপারটি নেহাতই ব্যক্তিগত বলে একে ব্যাপকভাবে কোনো পরিমাপের স্কেলে ফেলে বিচার করা কঠিন। পৃথিবীজুড়ে এটির সামাজিক-আর্থিক চিকিত্সার বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কোনো কোনো দেশে ভাবা হয়, এটি জীবনের স্বাভাবিক পরিবর্তন। তাই এর অসুবিধাগুলো চিকিত্সার পর্যায়ে ফেলার কোনো দরকার নেই। অনেকে বলবেন, হরমোন চিকিত্সার ঝুঁকির চেয়ে কিছু অসুবিধা মেনে নেওয়া ভালো। আমেরিকার উইমেনস হেলথ ইনিশিয়েটিভের (ডব্লিউএইচআই) অসমাপ্ত গবেষণার প্রকাশও এ রকম কিছু ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করেছিল।
৫০ বছরে পৌঁছে একজন নারী যখন ক্যারিয়ারের শীর্ষে, তখন হরমোনের অভাব তাঁকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করতে পারে। কিন্তু বেশ সহজেই প্রয়োজনীয় হরমোন দিয়ে তাঁকে এ অসহায় অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়া যায়। বার্ধক্য রোধ সম্ভব নয়, তবে এর আগমনটা একটু পিছিয়ে দিতে পারলে ক্ষতি কী। এই ভাবনাই পৃথিবীজুড়ে হরমোন থেরাপিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। মেনোপজে ‘কোয়ালিটি অব লাইফ’ এবং যৌনজীবন সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখার বৈজ্ঞানিক তথ্য আজ বহুলভাবে প্রমাণিত।
হরমোন চিকিত্সা: করোনারি হূদরোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, থ্রম্বোএম্বোলিজম।
প্রচলিত ধারণা: হরমোন প্রতিস্থাপন হূদযন্ত্র, রক্তনালি ও রক্তপ্রবাহ-সংক্রান্ত উল্লিখিত সব সমস্যা বাড়িয়ে দেয়।
সাম্প্রতিক গবেষণা: ৫০ থেকে ৫৯ বছর বয়স্ক সুস্থ নারীদের হূদযন্ত্র ও রক্তসঞ্চালন-সংক্রান্ত সব রোগের আশঙ্কা হরমোন চিকিত্সা কমাতে পারে।
ইস্ট্রোজেন হরমোন করোনারি রক্তনালিতে ক্যালসিফিকেশন কমায় (ডব্লিউএইচআইয়ের গবেষণায় প্রমাণিত)।
চিকিত্সার প্রথম দুই বছরে এর সুফল প্রমাণিত হয়েছে।
হরমোন প্রতিস্থাপন ও স্তন ক্যানসার
প্রচলিত ধারণা: হরমোন চিকিত্সাও স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
অল্প সময়ে স্তন ক্যানসারের উদ্রেক করে ও মৃত্যুর হার বাড়ায়।
ম্যামোগ্রাফি ব্রেস্ট ডেনসিটি বাড়ায়, যা স্তন ক্যানসারের পূর্বশর্ত বলে গণ্য করা হয়।
অন্যান্য ক্যানসারেরও ঝুঁকি বাড়ায়।
সাম্প্র্রতিক গবেষণা: পৃথিবীজুড়ে স্তন ক্যান্সারের কারণ, সূচনা ও ঝুঁকির হার নিয়ে বড় রকমের তারতম্য রয়েছে।
ঝুঁকিগুলোর মধ্যে জীবনযাত্রার ধরন, শরীরচর্চার অভাব, মদ ও তামাক সেবনকে প্রধান বলে ধরা হয়েছে।
হরমোন চিকিত্সার পর যুক্তরাষ্ট্রে স্তন ক্যানসার বেড়েছে বছরে প্রতি ১০ হাজারে মাত্র আটজন হারে। ডব্লিউএইচআই গবেষণায় তেমন কোনো বাড়তি দেখা যায়নি।
প্রথম সাত বছরে কেবল ইস্ট্রোজেনের ব্যবহার ওই ক্যানসারের হার বাড়ায় না, অনেক দিন ব্যবহারের পর ঝুঁকি বাড়ার খবর পাওয়া গেছে।
উন্নত দেশগুলোতে নিয়মিত স্ক্রিনিং পরীক্ষায় স্তন ক্যানসারের হার কমতে দেখা যায়নি।
হরমোন প্রতিস্থাপন ও অস্থি
প্রচলিত ধারণা: অস্থি সুরক্ষার জন্য হরমোন ব্যবহার নিরাপদ নয়।
অন্যান্য ওষুধের মতো হাড়ের ক্ষয় ও ভাঙা রোধে হরমোন যথেষ্ট সমর্থ নয়।
কিছু কিছু দেশের স্বাস্থ্য বা ওষুধ অধিদপ্তর হরমোনকে অস্থি রক্ষার চিকিত্সায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে রেখেছে। বলা হয়েছে, যেখানে অন্য ওষুধ কাজ করবে না বা দেওয়া যাবে না, কিংবা মোনোপজের অন্য উপসর্গ প্রকট, সেখানে হরমোন দেওয়া যেতে পারে।
সাম্প্রতিক গবেষণা: অস্থির ক্ষয়জনিত সব সমস্যায় হরমোন প্রতিস্থাপন একটি সফল চিকিত্সা। এটি অল্প ঝুঁকিপূর্ণ হাড় ভাঙাকেও প্রতিহত করতে পারে।
সুতরাং অস্টিওপোরোসিস রোগের জন্য এটি একটি ব্যয়সাধ্য, নিরাপদ ও প্রথম শ্রেণীর চিকিত্সা হিসেবে গণ্য হতে পারে।
অত্যন্ত কম মাত্রায় (ডোজে) এটির সুফল অস্থির ঘনত্বের ওপর প্রমাণিত।
অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও ডিস্ক সুরক্ষায়ও হরমোন চিকিত্সার সুফল প্রমাণিত।
হরমোন: স্মৃতিশক্তি ও সচেতনতা
প্রচলিত ধারণা: মেনোপজে স্মৃতিশক্তি ও সচেতনতা কমে।
হরমোন যেকোনো বয়সে স্মৃতিভ্রম বা স্মৃতি লোপ পাওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
প্রজেস্টেরন মস্তিষ্কের কোষে ইস্ট্রোজেনের প্রভাব প্রতিহত করে।
সাম্প্রতিক গবেষণা: মেনোপজ পরিবর্তনের সময় স্মৃতিভ্রম বা স্মৃতি লোপ পাওয়ার তেমন বড় কোনো প্রমাণ নেই। তবে অনেক নারী হটফ্লাশে অতিরিক্ত ঘাম, ঘুমের ব্যাঘাত ও মেজাজের পরিবর্তনের জন্য একই সঙ্গে স্মরণশক্তির ব্যাপারে কিছু অসুবিধায় পড়তে পারেন।
ইস্ট্রোজেন হরমোন মেনোপজের প্রথম দিকে (অল্প মাত্রায়) স্মৃতি লোপজনিত আলঝেইমার রোগে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তবে দেরিতে নিলে স্মরণশক্তি উন্নতির কোনো প্রমাণ নেই। এখানে প্রজেস্টেরনের কোনো সুফল গবেষণায় উল্লেখ নেই।
করণীয়
যেহেতু হরমোন মেনোপজের একটি প্রমাণিত চিকিত্সা, সে জন্য আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এ সম্পর্কি তথ্য-প্রমাণ সব শ্রেণীর মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
প্রাথমিক উপসর্গের জন্য কিছুদিন ব্যবহারের পর শরীর যখন হরমোনস্বল্পতায় আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাবে, তখন জীবনযাত্রায় শৃঙ্খলা ও খাবারদাবার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই আপনি নিজেকে সুস্থ রাখতে পারবেন। এসব নিয়ম ত্রিশোর্ধ্ব বয়স থেকে নিয়মিত পালন করলে বয়সকালে হরমোনের প্রয়োজন অনেক কমে যাবে।
বিকল্প হিসেবে যোগব্যায়াম, ম্যাসাজ, হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদ চিকিত্সা, ভিটামিন ও ক্যালসিয়ামের কথা বলা হচ্ছে।
যেসব খাবারে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে, যেমন—দানাদার শস্য, রঙিন ফলমূল, শাকসবজি, সয়াজাতীয় খাবার প্রচুর খাবেন।
হারিয়ে যাওয়া দেশি অনেক খাবার ও লতাপাতায় উপকার খুঁজতে পারেন। তিসি, মেথি, কালোজিরা, অঙ্কুরিত ছোলা, মিষ্টি আলু, দেশি অনেক মসলায় আপনি এসব অমূল্য জিনিস খুঁজে পাবেন।
সবশেষে সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতি আবেদন, অবিলম্বে বয়স্ক নারীদের স্বাস্থ্যসমস্যা সম্পর্কে কিছু কার্যক্রম এবং সে খাতে অর্থ বরাদ্দ করতে পদক্ষেপ নেওয়া হোক, যাতে এটি ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য তাদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে না দাঁড়ায়।
সুরাইয়া রহমান
মহাসচিব, বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটি
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২১, ২০০৯