১৮ অক্টোবর সারা বিশ্বে ‘বিশ্ব মেনোপজ দিবস’ পালিত হয়। ‘মেনোপজ’ শব্দটা নিয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা দূরের কথা, এ রকমটা এ বয়সে স্বাভাবিক, এভাবেই আমাদের পূর্বসূরিরা মেনে নিয়েছেন। তখন ‘কুড়ি’তে বুড়ি স্বাভাবিক ঘটনা। আজকের পৃথিবীর ৬৫০ কোটি মানুষ ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় ৯০০ কোটিতে পৌঁছার আশঙ্কা রাখে।
পৃথিবীর ঘনবসতি দেশগুলোর অন্যতম একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করে ৮৩৪ জন। দেশের বিরাট এই জনসংখ্যার অর্ধেকই প্রায় নারী। শতকরা ৪৯ জন। সেই হিসাবে মোট মেয়ের সংখ্যা প্রায় ছয় কোটি। এই ছয় কোটি মেয়ের ৪৬ বছর ও তদূর্ধ্ব মহিলার সংখ্যা শতকরা তিন থেকে পাঁচজন হিসাবে হয় প্রায় ২৮ থেকে ৩০ লাখ। একেবারে সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। এমন অবস্থায় প্রতিদিন বাড়ছে জনসংখ্যা, সেই সঙ্গে বয়োবৃদ্ধ নারীর সংখ্যা। উন্নত দেশগুলোতে নারীর গড় আয়ু ৮০ বছর আর বাংলাদেশে গড় আয়ু হচ্ছে ৬২ বছরের ঊর্ধ্বে (২০০১ সালের তথ্য)। তবে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমে রাখা মেয়েদের বিনা বেতনে শিক্ষাব্যবস্থা ও উন্নত স্বাস্থ্য প্রকল্প, যেমন-প্রসূতি, শিশু ও কিশোরীদের পুষ্টিমান উন্নত করা সম্পর্কিত কার্যক্রমগুলো শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার আরও কমাবে। এর ফলে নারীর গড় আয়ু ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। বর্তমানে প্রায় ২৮ থেকে ৩০ লাখ নারীর জীবৎকাল মেনোপজাল সময়ে কাটবে জীবনের এক-তৃতীয়াংশ। জীবনের শেষভাগের এই দীর্ঘ সময়ে কষ্টকর সমস্যা নিয়ে দুর্বিষহ-জীবন যাপন করার মতো দুর্ভাগ্য আর হতে পারে না। অথচ একটু সজাগ হলে, মেনোপজ সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা থাকলে, কিছু শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারলে জীবনের অবহেলিত সময়টাকেও অর্থবহ ও কর্মক্ষম করে তোলা যায়।
এ দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের বাস গ্রামে। সহজ-সরল, লাজুক গ্রাম্যবালা নিজের কোনো গোপন কথা, বিশেষ করে মাসিক ঋতুস্রাব-সংক্রান্ত কোনো বিষয় নিয়ে সহজে কারও কাছে মুখ খুলতে চায় না। মেনোপজ আসে তাদের জীবনে প্রাকৃতিক পরিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মচক্রে, এর বেশি কিছু জানা বা করার নেই তাদের। সবকিছু ভেবেচিন্তে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাই সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটির। এই সোসাইটির লক্ষ্য হচ্ছে অন্য সব শিক্ষার পাশাপাশি কিছু স্বাস্থ্যশিক্ষার সঙ্গে জীবনের প্রতিটি স্তরের পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতনতা জাগিয়ে তোলা। গণমাধ্যম বা মিডিয়াকে সম্পৃক্ত করে নীতি নির্ধারণ এবং অন্যান্য প্রযোজ্য কার্যক্রম প্রণয়নকারী সংস্থাগুলোকে পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করা।
মেনোপজ কীঃ ‘মেনো’ অর্থ মাস আর ‘পজ’ হচ্ছে বন্ধ হয়ে যাওয়া। প্রকৃতির স্বাভাবিক পরিবর্তনে মেয়েদের ‘ওভারি’ বা ডিম্বাশয়ে যখন মাসিকনিয়ন্ত্রক হরমোন ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্ট্রেরন আর তৈরি করে না, তখনই মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। মেনোপজের সময়কাল হচ্ছে চল্লিশের মাঝামাঝি বা শেষ থেকে পঞ্চাশের কোঠায়।
কীভাবে বুঝবেন মেনোপজ হতে যাচ্ছেঃ মাসিক অনিয়মিত হতে হতে বন্ধ হয়ে যাওয়া; ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত। গরম একটা তাপ ঢেউয়ের মতো মুখ, মাথা, কান, গলা থেকে বুক পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে (হট ফ্লাশ); সঙ্গে যথেষ্ট ঘাম হয়, বিশেষ করে রাতে। প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ নারী এই কষ্টে ভোগেন।
ক্লান্তি, অবসাদ, ঘুমের অসুবিধা। মেজাজের পরিবর্তন, অল্পে রেগে ওঠা বা উত্তেজিত হওয়া। উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ, বিষণ্নতা, হতাশা, শূন্যতার ভাব। দুর্বল স্মৃতিশক্তি, মনঃসংযোগের সমস্যা। প্রস্রাবের নানা অসুবিধা। যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যাওয়া। এ ছাড়া হরমোন স্বল্পতার প্রতিক্রিয়া শরীরে কিছু বিলম্বিত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারেঃ
হূদরোগ সমস্যাঃ মেনোপজের আগে পুরুষের চেয়ে নারীদের এ সমস্যা থাকে অনেক কম। মেনোপজের পর তা হয়ে যায় সমান সমান।
অস্থিক্ষয় সমস্যাঃ ইস্ট্রোজেনের অভাব শরীরের হাড়কে করে তোলে পাতলা ও ভঙ্গুর। ৬০ বছর বয়সে প্রতি চারজনে একজন হাড় ভেঙে শয্যাশায়ী হন। ৭০ বছর বয়সে শরীরের শতকরা ৫০ ভাগ হাড় ক্ষয় হয়ে যায়। এটা অবশ্য সাদা বা ককেশিয়ানদের পরিসংখ্যান।
কীভাবে কাটাবেন এই সময়ঃ একটা সুষম, সহজপাচ্য, কম ক্যালোরি কিন্তু অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবারের তালিকা বানান। এতে থাকবে প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল, ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ দুধ বা দুগ্ধজাত খবার, ভিটামিনসমৃদ্ধ সয়াজাতীয় খাবার এবং অনেক পানীয় রাখবেন প্রতিদিনের খাবারের তালিকায়। চর্বি, মিষ্টি, ভাজাপোড়া ও গুরুপাক খাবার বাদ দিন।
চিন্তা ও চাপমুক্ত, প্রয়োজনীয় বিশ্রামসহ একটি দৈনন্দিন জীবন।
কিছু ব্যায়াম, যোগাসন, হাঁটাচলা আপনার শরীরকে রাখবে ঝরঝরে, সচল ও কর্মক্ষম। যেসব কাজ করলে মন শান্তি পায়, করতে আনন্দ হয়, তা করার চেষ্টা করুন। ব্যস্ত রাখুন নিজেকে। ত্বকের যত্ন নিন।
এইচটি হরমোন-থেরাপি বা প্রতিস্থাপন প্রয়োজনে আপনার শারীরিক কষ্টগুলো নিরাময় করবে। তবে এ জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ও কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন হবে। এখানে উল্লেখ্য, মেয়েদের মতো পুরুষদেরও শরীর ও মন এ ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, যাকে বলা হয় এনড্রোপজ। মেয়েদের ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেনের অভাবের মতো পুরুষদের ক্ষেত্রে টেস্টোসস্টেরনের অভাবে এটা হয়ে থাকে।
লেখকঃ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব·) ডা· সুরাইয়া রহমান
উৎসঃ দৈনিক প্রথম আলো, ২৪ অক্টোবর ২০০৭